জাহাঙ্গীর হোসাইন চৌধুরী: বর্তমানে মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এক সর্বনাশা ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকদ্রব্যের বিস্তারে বিশ্ববাসী আজ শংকিত। দুরারোগ্য ব্যাধির মতই মাদক তরুণ ও যুব সমাজকে গ্রাস করছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন মাদকের ভয়াবহতা বাড়ছে। বিশেষ করে আামাদের মতো মধ্যম আয়ের দেশের জন্য মাদকাসক্তি একটি বিরাট সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। মাদকের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে সরকার মাদকের বিরোদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে, মাদকের বিরোদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি থাকা সত্ত্বেও যেন দেশ ও জাতিকে মাদকমুক্ত করা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। মাদকাসক্তি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে বিপদজনক দিক হচ্ছে এটি সমাজের তরুণ ও যুবকদের আকৃষ্ট করে সর্বাধিক। ফলে জাতির মূল্যবান সম্পদ তরুণ ও যুবকরা মাদকদ্রব্যের মায়াজালে আটকা পড়ে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। মাদকের ভয়ানক ছোবলে বিনষ্ট হচ্ছে অসংখ্য তরুণ ও যুবকের তাজা প্রাণ, আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অসংখ্য তরুণ ও যুবকের অমিত সম্ভাবনাময় জীবন। তরুণ ও যুবকরাই হচ্ছে জাতির মেরুদন্ড। সেই মেরুদন্ড আজ ভেঙ্গে পড়ছে মাদকের ভয়ানক থাবায়। মাদকের ছোবলে আক্রান্ত হয়ে ধুকে ধুকে মরছে লক্ষ লক্ষ কিশোর, তরুণ ও যুবক। আর্থিক ও সামাজিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের পরিবার।
মাদকদ্রব্য দাবানলের মতই ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে ও স্কুল-কলেজ, ভার্সিটিতে। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক এমদাদুল হক ২০১৮ সালে এক গবেষণায় বলেছেন, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে, যাদের অধিকাংশই ইয়াবাসেবী। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১০ সালে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৪৬ লাখ, বর্তমানে সে সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৭০ লাখ। যার মধ্যে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে এই গবেষণায় উঠে এসেছে, যা দেশের মোট মাদকাসক্তের প্রায় ৪২ ভাগ। মাদকসেবীর মধ্যে ৮০ ভাগের বয়সই ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে, বাকি ২০ ভাগ নানা বয়সের পুরুষ, নারী ও শিশু। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা ৬০ লাখ, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ইয়াবা আসক্ত। বাংলাদেশে এক সময় মাদক হিসাবে হেরোইন ও ফেনসিডিল বহুল প্রচলিত থাকলেও ১৯৯৯ সাল থেকে ভয়াবহ মাদক ইয়াবা ধীরে ধীরে সে স্থান দখল করে নেয়।
মাদকের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে মাদকের সরবরাহও বেড়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের প্রায় ৩০ টি রুটের ৫১২ টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য প্রবেশ করছে। এসব পয়েন্টে বিজিবি এর বিশেষ নজরদারি থাকা সত্ত্বেও প্রতিদিন হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেডিন, আফিম, বিয়ার, মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য প্রবেশ করছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ১৫ টি পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছে ভয়াবহ মাদক ইয়াবার বড় বড় চালান। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে এসব রুট দিয়ে আসা ৪ কোটি ইয়াবা, ৪০১ কেজি হেরোইন, ৭ লাখ ২০ হাজার বোতলের বেশি ফেনসিডিল এবং ৬৯ হাজার কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। আইন-সৃঙ্খলা বাহিনীর এক তথ্যসূত্রে জানা যায়, যে পরিমাণ মাদকদ্রব্য আটক হয় তা আমদানিকৃত মাদকের শতকরা ১০ ভাগ। আমদানিকৃত মাদকের বাকি ৯০ ভাগ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে পৌছে যাচ্ছে বিভিন্ন শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে মাদকসেবীদের কাছে।
মাদকাসক্তি বৃদ্ধির ফলে দেশে মাদকদ্রব্যের অবৈধ ব্যবসা ও মাদকের চোরাচালান বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, অবৈধ মাদকদ্রব্য আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটির বেশী টাকার মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করছে, কিন্তু মাদক সমস্যা সে প্রচেষ্টার পথে হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী একজন মাদকাসক্ত মাদক সেবনের পেছনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা খরচ করে, তবে বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই প্রতিদিন খরচ ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। অধিদপ্তরের অন্য আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু ইয়াবার পেছনেই সেবনকারীরা দিনে খরচ করছে প্রায় ১৩৫ কোটি টাকা, বছরে এ অংক দাড়ায় ৪৮ হাজার ৬ শত কোটি টাকা। নেশার টাকার জোগান দিতে মাদকসেবীরা চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন ও মাদক ব্যবসা সহ নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবে অপরাধ প্রবণতাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদক ব্যবহারকারীরা মাদক সেবনের জন্য টাকা জোগাড় করতে ও মাদক সেবন করে নানা ধরণের অপকর্ম ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন নামক পত্রিকার ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারীর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এক যুগে মাদকাসক্ত ছেলের হাতে ২৭৩ জন মা-বাবা নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, একই সময়ে মাদকাসক্ত স্বামীর হাতে প্রাণ গেছে ৩ শতাধিক নারীর, মাদকসেবী বাবার হাতে ১১ জন সন্তান হত্যার মতো নৃশংসতাও ঘটেছে। মাদক কেনা-বেচা ও আধিপত্য বজায় রাখার সংঘাতে গত এক বছরে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১১৪ টি। মাদকের টাকা জোগাড় করতে মাদকসেবীরা প্রায়ই লোমহর্ষক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে, গত বছরের ১১ আগষ্ট অন্য একটি পত্রিকার খবরে প্রকাশ, কক্সবাজারের চকরিয়ায় ইয়াবা আসক্ত রেজাউল করিম তার স্ত্রীর কাছে মাদক সেবনের জন্য টাকা চেয়ে না পেয়ে স্ত্রীর অগোচরে দেড় বছরের কন্যাসন্তানকে বিক্রি করে দেয়। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে মাদকের টাকা দিতে না পারায় সাহেরা বেগম নামক এক সন্তানসম্ভবা গৃহবধুকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পাষন্ড স্বামী আপেল মিয়া। গত ৪ জানুয়ারী রাজধানীর পল্লবীতে মাদকাসক্ত রাসেল মাদক সেবনের জন্য মায়ের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে লোহার রড দিয়ে পিঠিয়ে তার মা কে হত্যা করে, গত ২৭ আগস্ট বগুড়ার দুঁপচাচিয়ায় নেশার টাকার জন্য ভ্যান ছিনতাই কালে চিনে ফেলায় ভ্যান চালক সমজান আলীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মাদকসেবীরা। প্রতিদিনই এরকম অসংখ্য লোমহর্ষক ঘটনার সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে দেশের পত্রপত্রিকাতে।
দেশে দিনদিন বেড়েই চলেছে মাদকের ভয়াবহতা, মাদকাসক্তি আমাদের সমাজে এখন মহামারি আঁকার ধারণ করেছে। সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে মাদকের বিরোদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্ট করা হচ্ছে, তবে তা এখনো অপ্রতুল বলা যায়। কারণ মাদক এখন শহর এলাকা ছাড়িয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে গেছে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে, অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার অভিযান ও মাদক ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সীমান্তের কোন রুট দিয়ে যেন মাদক আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদকবিরোধী সচেতনা সৃষ্টির লক্ষে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। মাদক প্রতিরোধে প্রতিটি পরিবারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, প্রতিটি পারিবারের উচিৎ তার স্বজনদের মধ্যে মাদকবিরোধী সচেতনতা তৈরী করা। আমরা যদি এখনই মাদকের বিরোদ্ধে কার্যকারী পদক্ষেপ না নিতে পারি তাহলে আগামীতে এর পরিণাম হবে আরও ভয়াবহ।
লেখক : মাদকবিরোধী সংগঠক ও কলামিস্ট।